রাধা কৃষ্ণের চিরন্তনী প্রেম একসূত্রে বেঁধেছে মদনপুর ও বিরোহী গ্রামদুটিকে

বছর দুয়েক আগের কথা, নভেম্বরের এক সকালে অফিসের কাজে চলেছি কৃষ্ণনগর । দিনটা ছিল আলো ঝলমলে শুক্রবার । ফাঁকা হাইওয়েতে দুপাশ দিয়ে সাঁইসাঁই করে পেরিয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ ধান সবজি আর সর্ষের ক্ষেত ।
মিনিট চল্লিশ যাবার পর হরিণঘাটা পার করে রাস্তার ধারে দেখি পালে পালে গরু দাঁড়িয়ে । ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতে বললো আজ হাট বসেছে । রবিঠাকুরের কল্যাণে ছোট থেকে জেনে আসছি হাট মানেই উচ্ছে বেগুন পটল মূলো, মানে পদহীনদের সমাহার কিন্ত এযে দেখি চারপেয়েদের ভীড় ! দিনটা যদিও শুক্রবার আর নদীও একটা পাশে আছে বটে, তবে মজা……. পদ্মা নয় ।
সুতরাং চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জনের উদ্দেশ্যে রথ হইতে অবতরণ, সঙ্গী মিলের লেবার সাহেব জনৈক গোপনন্দন ! গো সন্দর্শনে এনার থেকে ভাল সাথী আর কে হতে পারে ?
স্থান নদীয়ার হরিণঘাটার কাছে, মদনপুর রেল স্টেশন থেকে যে রাস্তাটা এসে চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়কে মিশেছে, সেই মোড়ের পাশে।জানা গেলো প্রতি শুক্রবার এখানে ভোর থেকে গোরুর হাট বসে, চলে দুপুর একটা দুটো পর্যন্ত। একটা দড়ির সঙ্গে বাঁধা সারি সারি গোরু……ওই দড়িটাই বন্ধন,কেউ বন্ধন খুলে দিতে আসে কেউ বা বন্ধনে জড়াতে !
হাট যখন তখন কচুরি জিলিপি থাকবেই, খুঁজেপেতে আমাদের প্রবেশ জঠরাগ্নি নিবারণে , সাথে উপরি পাওনা যদি জানা যায় অজানা কোন ইতিহাস । পোষাক আশাক দেখে দোকানের মালিক নিজেই বেরিয়ে খাতির করে বাঁশের তৈরী বেঞ্চিতে বসালো ।
জায়গার নাম বিরহী আর সেই নামেই হাট । গরম ফুলকপির তরকারি দিয়ে খান চার কচুরি পেটে চালান করার পরই মুখ খোলার ফুরসত পেলাম, তা ভাই কার বিরহে এই নামকরণ ? দোকানী এবার মাথা চুলকায়। পাশের বেঞ্চে বসে কাগজ পড়ছিলেন এক বৃদ্ধ, তিনি হেসে বললেন ও ব্যাটা ময়রা সারাজীবন চিনির রস নিয়েই জীবন কাটালো, বিরহ আর দেখলো কোথায় ? শুনুন তবে ….
সে অনেকদিনের কথা,এখানকার এক বালকের নাম ছিল গোপাল। জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার দিন বন্ধুদের নিয়ে গোপাল গোরুর পাল নিয়ে হালদার পাড়ার মাঠে চরাতে গিয়েছে। বন্ধুরা বলল, ‘চল গোপাল, রথ দেখে আসি।’ গোপাল বলল, ‘তোরা যা, আমি তোদের সব গোরু পাহারা দিই!’ বৃন্দাবনে তীর্থ করতে যাওয়ার রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে গোপাল তবু সেই নেতা। বন্ধুরা গেল রথ দেখতে আর গোপাল পড়ল ঘুমিয়ে। গোরুর পাল গ্রামের সব শস্যক্ষেত শেষ করে দিল। গ্রামবাসীরা তা দেখে তাড়া করে গোপালের পিছনে। প্রাণভয়ে ভীত গোপাল দৌড়ে লুকিয়ে পড়ে এক কাঁঠাল গাছের ভিতরে। লুকিয়ে পড়ে ভুল বললাম, গাছের মধ্যে মিশে যায় গোপাল। সেই থেকে এলাকার মানুষের কাছে রাখাল গোপালই হয়ে ওঠে শ্রীকৃষ্ণ।
বহু বছর পরে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নে সেই দৃশ্য দেখে এই গ্রামেই তৈরি করেন মদনমোহনের মন্দির। কাঁঠাল গাছের কাঠ থেকেই তৈরি হয় মূর্তি। এই মন্দিরের জন্যই নিকটবর্তী রেল স্টেশনের নামকরণ হয় মদনপুর ।
কিছুদিন বাদে রাজা আবার স্বপ্ন দেখেন…. মদনমোহন বলছেন, ‘বিরহ যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি। আমায় রাধা এনে দাও।’ রাধা তৈরি হয় পাশের যমুনা নদীতে ভেসে আসা এক নিম কাঠ থেকে। সেই থেকে গ্রামের নাম হয়ে গেলো বিরহী !
কিন্ত দয়িতার সঙ্গ পেয়েও কেন বিরহ ?
মনে পড়ে গেলো শচীন কত্তার সেই বিখ্যাত গান… বিরহ বড় ভালো লাগে……।
গো হাট থেকে সামান্য দূরে, মজে যাওয়া যমুনা নদীর ধারে, গহন ছায়ামাখা মদনমোহনের মন্দিরে এখনও পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সেই রাখাল বালক রূপী মদনমোহন পাশে রাধাকে নিয়ে। আর এখানে এই গো হাটে প্রতি শুক্রবারে জড়ো হচ্ছে অসংখ্য গোরুর পাল। তারা আর বহু যুগ আগের রাখালের গোরুর পালের মতো কোনও দুষ্টুমি করছে না, লোকের ক্ষেতও নষ্ট করে দিচ্ছে না। এরা কেউ যাবে নতুন গোশালায়, কেউ যাবে খাটালে আবার কেউ কসাইখানায়। চোরাচালানকারীদের দড়ি ধরে কেউ বা পাড়ি দেবে ভিন দেশে।
গল্প শুনে সঙ্গী যাদব নন্দন ইমোশনাল হয়ে পড়লেন …. বললো আজ নয় নাইবা গেলাম, চলুন মিলে ফিরে যাই! মুচকি হেসে বললাম, ও আমার চিরকালীন রাখাল, জীবন তো এ রকমই….. গাড়িতে উঠুন ।
বিরহিনী রাধার মতো আমাদের নিয়ে গাড়ি ছুটলো কৃষ্ণনগরের পথে । 🚕🚗🚓
~ Swapan Sen